গল্প- বিরতি

বিরতি
-রীণা চ্যাটার্জী

ঠিক সকাল নটা সাঁইত্রিশ, না না আরো দুই থেকে চার মিনিট আগেই দেখা হয় রোজ।
দেখা হয় মানে দেখতে পাওয়া। চোখাচোখি হওয়ার সুযোগ নেই, কারণ ভঙ্গীটা রোজের একইরকম- চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ, হাতে খবরের কাগজ, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়ে একদম নির্লিপ্ত। মধ্যপঞ্চাশের অফিসযাত্রী। হাতে খবরের কাগজটা নিয়ে তাতে চোখ রেখেই পেরিয়ে যান মেট্রোরেলের এক একটা ধাপ- লিফটে ওঠা, গেটের বিধিনিষেধ পেরিয়ে প্লাটফর্মে হাঁটা, ট্রেনের অপেক্ষা, ট্রেন এলে উঠে বসা সবকিছুতেই কাগজ থেকে কিন্তু চোখটা সরে না। যেন কাগজটার প্রতিটা ইঞ্চিতে গভীর অনুরাগ। কখনো এ পাতা, কখনো ও পাতা, এই দু’ ভাঁজ তো পরক্ষণেই চার ভাঁজ, তারপর আটভাজা, শেষে কোনও বিশেষ একটা জায়গা খামচে ধরে চোখের সামনে রাখা। ‘কাগজ ভিজিয়ে’ পড়ছে এই কথাটা অনেকবার শুনেছে মৃদুল। কিন্তু এ তো ভেজানো নয়- ভাজাভাজি করা, খবর কবর থেকে বের করে আনা প্রায়। উৎসুক মন প্রায় মাস দুয়েক দেখতে দেখতে উৎসাহে আরো উৎসুক হয়ে উঠলো। কি এতো পড়তে পারে মানুষ? কোনও দুই একটা বিশেষ বিষয়ে আগ্ৰহ থাকতে পারে, কিন্তু… যাই হোক না কেন, ইচ্ছেটা পাশে থেকে দেখা, কি এতো যুদ্ধ করেন নিরীহ খবরের কাগজের সঙ্গে ভদ্রলোক! সুযোগ খুঁজলেই পাওয়া যায়, মিলে গেল। একদিন পাশে বসার জায়গা পেয়েই গেল মৃদুল, শুধু দেখার কাজটাই বাকি। কিন্তু দুর্ভাগ্য কাগজটি তখন ভাজাভাজির পালা সেরে প্রায় আট ভাঁজে, দশ আঙুল আর চোখের কবলে। অন্য কারোর দেখার উপায় নেই। পাশে বসেও বিশেষ সুবিধা করতে পারলো না। তবে চেষ্টা চালিয়ে গেল রোজের যাতায়াতের সময়। মেট্রোরেলে মিনিট ছয়েক জার্নি, সময় বড়ই কম। মেট্রো থেকে নামার পরেও এক ভঙ্গীতে তিনি এগিয়ে যান অটোস্ট্যান্ডের দিকে। ওই ফাঁক গলেই তিনি চোখছাড়া হয়ে যান, এক অটোতে বসার সুবিধা হয়ে ওঠে না। হয় তিনি আগে, নয় মৃদুল আগে, এই আগে-পরের চক্করে খবরের কাগজ ব্যবহারের শেষ পর্যায় আর দেখা হয়না। পরের ব্যাপারে নাক গলানোর ভীষণ বদ অভ্যাস জেনেও স্বভাববিরুদ্ধ এই বদ অভ্যাসে দিন দিন অস্বস্তি বাড়তে থাকে। ভেতরে একটা খচখচানি- একটা কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ার অস্বস্তি। এমন অবস্থা হলো- ওনার চোখ কাগজে, মৃদুলের চোখ ওনার ওপর। আশেপাশের লোক যে তার আচারণেও কিছু ভাবতে পারে- সেই বোধ মেট্রোরেলের চাকায় বোধহয় পিষে গেছে।

সবদিন তো আর সময় যায় না। কথায় আছে “উদ্যোগিনং পুরুষ সিংহ…” লক্ষ্মীলাভ এখানে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু উদ্যোগ প্রায় সফল। অটোয় পাশাপাশি বসার জায়গা হয়েই গেল। মৃদুলের মনে স্ফুর্তির স্ফুলিঙ্গ, ‘যাই করো বাপধন এখানে আর রেহাই নেই, তোমার ভাজাভাজি আজ দেখবই।’ যখন গুছিয়ে পাশে বসলো, ওনার চোখ ততক্ষণে আবার কাগজে। আশ্চর্য! চোখটা রাখলো ওনার কাগজে, কিন্তু এতো কাছাকাছি, পাশাপাশি বসেও… নাহ্, শুধু কালো পিঁপড়ের সারি, কাগজটা তখন প্রায় মুঠোবন্দী। মৃদুলের গন্তব্য এসে গেল ওনার আগেই। এমন সময়েই মুচমুচে কাগজটা প্রায় মন্ড পাকিয়ে ব্যাগে ভরে রাখছেন। এতোক্ষণে মনোযোগী পঠনে বিরতি পড়লো। দীর্ঘশ্বাস…মৃদুলের। মুখ ফস্কে বলেই ফেললো, শেষ হলো যুদ্ধ? উনি তাকালেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। বললেন, ‘আমাকে কিছু বললেন?’ চুপচাপ ভাড়াটা মিটিয়ে নেমে গেল- বাকযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই। অবশ্য আর দেখা হয়নি ওনার সঙ্গে বেশ কিছুদিন হলো। ট্রেনের টাইমটা বদলে নিয়েছিল মৃদুল। ভয়ে? হতেই পারে- প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেওয়ার পর আর মুখোমুখি হতে চায়নি। হয়তো-বা বিরতি দিয়েছিল এই অহেতুক উৎসাহে, বদভ্যাসের বিরতিও বলা যেতে পারে।

Loading

Leave A Comment